বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’র গল্প - তাবাসসুম ফাতেমা | প্রবন্ধ
‘কবিতাকে যথোচিত গৌরবে বিশেষভাবে ছেপে থাকে এমন সাময়িকপত্র বর্তমানে দেশে বেশি নেই। অথচ আধুনিক কবিদের অনেকেই নতুন কবিতা লিখছেন, বাইরের পাঠকমণ্ডলী দূরে থাক, অনেক সময় নিজেদের মধ্যে সেগুলো দেখাশোনার সুবিধে হয় না। এই কারণে আমরা একটি ত্রৈমাসিক কবিতাপত্র বার করতে বাধ্য হচ্ছি। পত্রিকার নাম হবে ‘কবিতা’ এবং তাতে থাকবে শুধু কবিতা।’
এটি ১৯৩৫ সালে কলকাতার সাহিত্যপত্রিকা বিচিত্রায় প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, "কলকাতায় ভালো পত্রিকা অনেক ছিল, কিন্তু এমন কোনো পত্রিকা ছিল না যার মধ্য দিয়ে কবিতা হতে পারে বিশেষভাবে প্রকাশিত, প্রচারিত ও রসজ্ঞানের দৃষ্টিগোচর"। সে সময়ে উল্লেখযোগ্য কিছু পত্রিকা ছিল সবুজপত্র, কল্লোল, পরিচয় ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো ছিল রবীন্দ্রনির্ভর। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবশালী বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সেই তিরিশের দশকে যেসব কবি সংগ্রাম করেছেন, তাদেরকে 'প্রোমোট' করার মতো কোনো প্লাটফর্ম ছিল না। আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসু এই অভাব তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন।
সাহিত্যপত্রিকাকে ঘিরে আড্ডার ঐতিহ্য বাংলায় সবসময়ই ছিল। ‘পরিচয়’ পত্রিকার এক আড্ডায় কবি অন্নদাশংকর রায়ের হাতে "পোয়েট্রি" নামের এক ইংরেজি পত্রিকা দেখলেন বুদ্ধদেব বসু। তখনই তাঁর মাথায় কেবল কবিতাকেন্দ্রিক একটি পত্রিকা করার ভাবনা এলো। পোয়েট্রি'র অনুকরণে তিনি সে পত্রিকার নাম রাখলেন ‘কবিতা’। ত্রৈমাসিক এ পত্রিকায় ছাপানো হবে কবিতা, কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ, সমালোচনা ইত্যাদি।
এর আগে বুদ্ধদেব হাতে লেখা কাগজ পতাকা, ক্ষণিকা এবং মাসিক প্রগতির সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এবারের কাজটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং অনেকটা কঠিনও। অর্থের প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত হলো চাঁদা তোলা হবে। কবি'র স্ত্রী প্রতিভা বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘প্রথম চাঁদাটা যে আমিই তুলেছিলাম সেটা ভুলিনি। ...চাঁদার হার পাঁচ টাকা। বুদ্ধদেব পাঁচ টাকা, প্রেমেন্দ্র মিত্র পাঁচ টাকা, মায়া মাসিমা পাঁচ টাকা, পনেরো টাকা তো উঠেই গেল। কী ফূর্তি সকলের। বাড়ি ভেসে গেল খুশির জোয়ারে।...শেষ পর্যন্ত পয়ত্রিশ টাকা চাঁদা উঠতেই শুরু হয়ে গেল কাজ।’ এসময়ে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদনার কাজে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে পেয়ে গেলেন। পূর্বাশা প্রেস থেকে ছাপানো হলো প্রথম সংখ্যাটি। সৌভাগ্যের বিষয়, প্রেসের মালিক কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য ছাপানোর কাজটি বিনামূল্যেই করে দিলেন। ১৯৪৫ সালের পহেলা অক্টোবরে প্রকাশিত হলো ‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা। শুরু হলো আধুনিক কবিতার প্রথম ও প্রধান মুখপাত্র'র সাহিত্যযাত্রা।
এ পত্রিকা বেশ সাড়া জাগাতে পারল। আলোচনা-সমালোচনা চলতে লাগল। এক কপি কবিতা'র দাম ছয় আনা, বার্ষিক দেড় টাকা। প্রথম বছরেই এর গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়াল সত্তরে। দু' বছর না যেতেই প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদনা থেকে সরে গেলেন। বুদ্ধদেব একাই টেনে নিতে লাগলেন কবিতাকে। টানা ২৫ বছর এই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়। সেই তিরিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডবের সকলেই এ পত্রিকায় লিখতেন। বুদ্ধদেব তাঁদেরকে নিয়ে আধুনিক কবিতার আন্দোলনকে সংহত করেন। বাংলা সাহিত্যে এ পত্রিকার অবস্থান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এখানে কবিতা ছাপা হওয়া মানেই যেন কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাওয়া। কবিতা'র নিরপেক্ষতাও ছিল অসাধারণ। বুদ্ধদেব বসু থেকে ভিন্ন ধারার কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের হয়েছিল। শুধু কবিতার খাতিরেই, সাহিত্য আর রাজনীতিতে বিপরীতে মেরুর লোক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও এখানে গুরত্ব পেত। মোট ৩৪৫ জন লেখক এখানে লেখেন। এর মধ্যে পূর্বোক্ত কবিগণসহ উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ।
এঁদের মধ্যে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় জীবনানন্দ দাশের কথা। জীবনানন্দ যখন রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন সকলের কাছে অবহেলিত, তখন এগিয়ে এলেন বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় মাত্র ১৬৭টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, যার ৯৭টিই ছিল কবিতায় প্রকাশিত। তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনাও ছাপা হতো এ পত্রিকায়। বাংলায় নতুন ধরণের কবিতা লিখতে থাকা জীবনানন্দকে সব নিন্দা-সমালোচনা আর তাচ্ছিল্য থেকে রক্ষার দায়িত্ব বুদ্ধদেব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কবিতা'র আর সব কীর্তি বাদ দিলেও, জীবনানন্দকে তুলে ধরা, তাঁর মৃত্যুর পর জীবনানন্দ সংখ্যা প্রকাশের জন্যও পত্রিকাটি অমর হয়ে থাকবে।
বুদ্ধদেব বসু কবিতা'র প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর সভয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক কপি পাঠিয়েছিলেন, এবং একটা লেখা প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, বিশ্বকবি তাঁদের পত্রিকার জন্য একটি কবিতা পাঠিয়েছেন। সাথে প্রশংসাসূচক মন্তব্যও, ‘‘তোমাদের ‘কবিতা’ পত্রিকাটি পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। এর প্রায় প্রত্যেকটি রচনার মধ্যেই বৈশিষ্ট্য আছে। সাহিত্য-বারোয়ারি দল-বাঁধা লেখার মতো হয়নি। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে এরা নূতন পরিচয় স্থাপন করেছে।’’
বাংলা সাহিত্যে আহসান হাবীবের মতো উল্লেখযোগ্য সম্পাদকও এসেছেন। অনেক সাহিত্য-পত্রিকা, লিটলম্যাগ ইত্যাদি এসেছে। বর্তমানে অনলাইনে সাহিত্যচর্চার চল শুরু হওয়ার পরেও এসবের আবেদন এখনো দৃশ্যমান। এসব পত্রিকার আদর্শ হয়ে থাকবে ‘কবিতা’। অনুকরণীয় সম্পাদক হিসেবে সবার আগে ঢাকার ছেলে বুদ্ধদেব বসুরই নাম আসবে।
লেখক:
তাবাসসুম ফাতেমা |
কোন মন্তব্য নেই