দহন হাসান – মোহাম্মদ শাহরিয়ার | গল্প
আজ কিছুটা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে আনিস। ইদানীং তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে সে। এসে আরিফের পাশে বসে, তাকে গল্প শোনায়, মাথা টিপে দেয়। আরিফ এটা ওটা বায়না ধরে, বায়না ধরলে পূরণ করার চেষ্টা করে। আজ বায়না ধরেছিলো ইলিশ মাছ খাওয়ার, এই সময়ে তো সে আরিফের চাওয়া ফেলে দিতে পারে না। কষ্ট করে হলেও কিছু টাকা বাঁচিয়ে, সেই সাথে আরিফের মায়ের জমানো কিছু টাকা নিয়ে একটা মাঝারি সাইজের ইলিশ কিনে এনেছে।
আরিফের শুষ্ক চুলে আনমনে হাত বোলোচ্ছিলো আনিস।
"বাজান আমি ইস্কুলে কবে থেকে যামু"?
" এইতো বাজান সামনের মাস থেইকাই"
"এইখানে সারাদিন শুইয়া থাকতে ভাল্লাগে না। তুমি না কইছো ওষুধ খাইলে ভালো হইয়া যামু"
"হ বাজান, কদিন বাদেই ভালো হইয়া যাবি।
" আচ্ছা আমার কি অইছে? খালি মাথা ব্যথা করে ক্যান?
আনিস নির্বাক চেয়ে থাকে তার নিষ্পাপ ছেলের দিকে। মুখে কোনো কথা নেই। আরিফের ব্রেইন টিউমার। সবেমাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে, ব্রেইন টিউমার কী এটা বোঝার বয়স এখনো হয়নি। ইদানীং আরিফের মাথাব্যথাটা খুব বেড়েছে।যন্ত্রণায় ছটফট করে। ডাক্তার বলেছে দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। বড়জোর চার সপ্তাহ অপেক্ষা করা যাবে। সে চিন্তায় গত কয়েকদিন ঘুম হয় না আনিসের। আরিফের মা মুখ লুকিয়ে কাঁদে। একমাত্র সন্তান তাদের। প্রায় আট লাখ টাকা দরকার।কোত্থেকে পাবে এতটাকা? হাজার সাতেক টাকা বেতনে গার্মেন্টসে চাকুরী করে। টানাটানির সংসার, দুহাজার টাকা ঘরভাড়া। ধারদেনা করে চলতে হয়,ওষুধ কেনার টাকা জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। জমিজমা নেই কিছুই,বসম্বল শুধু আরিফের মায়ের দুইভরি গয়না।বসেগুলো বিক্রি করেও তেমন লাভ নেই। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে আনিস।
পরদিন সকালে কাজে বের হলো সে। সামনে ঈদ। গার্মেন্টসে কাজের চাপও বাড়ছে। কাজে মনযোগ নেই তার ।ওদিকে আরিফের সময় ঘনিয়ে আসছে। কোনো উপায় এখনো বের হয়নি। এত টাকা সাহায্য করার মতো লোকও নেই। মেশিনের গড়গড় শব্দে আনমনে কাজ করতে থাকে সে।
হঠাৎ চারপাশে মানুষের চিৎকার-চেচামেচি শোনা গেলো।পাশের রুম থেকে আগুনের প্রচণ্ড ধোঁয়া আসতে লাগলো।জীবন বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে সবাই এদিক-সেদিক ছুটছে।ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। আনিস দৌড়ে এগিয়ে গেলো। বাঁচার জন্য ভীড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও হঠাৎ কী ভেবে পেছনে ফিরে এলো। কোনোরকম বাঁচার চেষ্টা করলো না। এলোমেলো ভাবছে সে। আট লাখ টাকা... শ্রমিকের জীবনের মূল্য বেশি না হলেও অন্তত চার -পাঁচ লাখ টাকা তো অনুদান মিলতে পারে। তার আদরের আরিফের একটা ব্যবস্থা তো হতে পারে...
দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে আনিসের দেহ। সে সঙ্গে তার স্বপ্নও হয়তো!
লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই