Header Ads

Header ADS

প্রত্যাবর্তনের লজ্জায় আল মাহমুদ





কমলাপুর রেল স্টেশন চালু হয় ১৯৬৮ সালের ১লা মে। এর আগ পর্যন্ত ঢাকার রেলস্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়া স্টেশন। ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’  গ্রন্থে আল মাহমুদ লিখেছেন—“১৯৬০ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি এক শীতের সকালে আমি একটি ভাঙা স্যুটকেস হাতে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামলাম।” (রাজনীতিতে মেজর জিয়ার আর সাহিত্যে আল মাহমুদের ভাঙা স্যুটকেস খুবই বিখ্যাত।) মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করে আল মাহমুদ কবি হওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন, নিঃসম্বল অবস্থায়। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, কবি হওয়ার জন্য ঢাকায় আসা— এ কেবল আল মাহমুদের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ নামে তাঁর একটা কবিতা আছে। যেখানে তিনি শেষ ট্রেন ধরবেন বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখেন, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল, ট্রেনের জানালায় তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ, তারা তাঁকে সান্ত্বনা জানায়। সাত মাইল হেঁটে এসে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে তিনি এক অখ্যাত স্টেশনে কাঁপতে থাকেন। তারপর নিজের গ্রামে ফিরতে শুরু করেন। এই কবিতার গল্পটা রূপক। আল মাহমুদ তার জীবনে কোথায় পৌঁছতে গিয়েও আগের জায়গায় ফিরে আসেন?

আমরা জানি, আল মাহমুদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ থেকে উৎকৃষ্ট কবিতা বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, যেই পত্রিকা মুজিববিরোধী তথা জাসদপন্থী ছিল। পত্রিকাটি সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, আর গ্রেফতারের শিকার হতে হয় কবিকে।

আল মাহমুদ পীর বংশের ছেলে। পারিবারিকভাবে ধর্মীয় আবহে তিনি বড় হন। কিন্তু সে সময়টায় তিনি ঝুঁকে ছিলেন নাস্তিকতার দিকে। একদা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, “আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে/অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।” পঁচাত্তর সালে তিনি মুক্তি পান। এরমধ্যেই, কারাগারে থাকা অবস্থায় তার মনোজগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। তিনি লেখেন: “আমি কুণ্ডলীকৃত কালো ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে/ধ্বংসের ওপর রেখে আসা আল্লার আদেশ/বুকে তুলে নিলাম।”

জেল থেকে বেরিয়ে যখন তিনি তাঁর বিশ্বাসের পরিবর্তনের কথা জানান, তখন পুরানো বন্ধুদের কাউকে তিনি পাশে পেলেন না। পরিজনহীন কবি, ঢাকা মহানগরীতে যেন এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। যেরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির দেখা পাই আমরা “প্রত্যাবর্তনের লজ্জা” কবিতায়, যখন তিনি ট্রেন মিস করে বাড়ি ফিরে আসেন এবং নিজের প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে মায়ের আঁচলে ঘষে তুলে ফেলার কথা বলেন। এই লজ্জা কি তবে ধর্মীয় আবহে বড় হয়ে শহরে গিয়ে অবিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে সেই পথে পুরোপুরি না গিয়ে ইসলামের দিকে ফিরে আসার কারণেই? এই কবিতায় “ফাবি আইয়ি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান” পড়ি, যেটা, কবি'র দাবী অনুযায়ী, বাংলা কবিতায় কোরানের আয়াতের প্রথম সার্থক ব্যবহার। এই আয়াত কি ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনকেই ইঙ্গিত করে?

কিন্তু না, আমরা এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে পারছি না। কারণটা সহজ। এই কবিতাটি যেই সোনালি কাবিন গ্রন্থের, তা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৩ সালে। আর আল মাহমুদের বিশ্বাসের পরিবর্তন হয় ৭৫-এ। তাই আমরা ভিন্ন এক ব্যাখ্যার দিকে যেতে চাই।

দশকের হিসেবে আল মাহমুদের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকে। সেসময় যারা তাঁর সতীর্থ কবি ছিলেন, যেমন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, তাঁরা তখন সমানে নগরকেন্দ্রিক কবিতা লিখে চলেছেন। কিন্তু আল মাহমুদ সে পথে গেলেন না, বাংলা কবিতায় তিনি সংযোজন করলেন এক অসামান্য অধ্যায়ের। তিনি আধুনিক কবিতায় গ্রামকে নিয়ে এলেন। গ্রামে প্রচলিত শব্দকে অসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রয়োগ করলেন কবিতায়। সোনালি কাবিন কবিতার একটি লাইন “তস্করের হাত থেকে জেয়র কি পাওয়া যায় ত্বরা”, তস্কর, জেয়র (অলংকার), ত্বরা, এরকম অজস্র গ্রামীণ শব্দ আল মাহমুদের আগে বাংলা কবিতায় কেউ ব্যবহার করেনি। “পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ”-এর কথা, শস্যের শিল্পী, খেতের আল, খড়ের গুম্বজ, নদীর ভাঙন, বাছুর হারিয়ে ফেলা সলিমের বউ, লাউমাচা আর দুগ্ধবতী হালাল পশুর মতো চিরায়ত বাংলার আরো অনেক লোকজ প্রসঙ্গের দেখা মেলে তার কবিতায়। এসব কবিতায় গ্রামবাংলার মাটির নিবিড় ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

আল মাহমুদ কবি হওয়ার জন্য ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে আক্ষরিকভাবে গ্রাম থেকে শহরে গেলেও, কবিতায় তিনি তার তাঁর সহযাত্রীদের মতো গ্রামকে ছেড়ে যাননি। এর জন্য তাকে কটাক্ষের শিকারও হতে হয়েছিল। তিনি হয়ত বিব্রতও হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলা মায়ের আঁচলে, তিনি সমস্ত দ্বিধাকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। আর কোরআনের ওই আয়াত, সেটা কেবল গ্রামবাংলার একটা সাধারণ চিত্র হিসেবেই এসেছে। কবি ব্যক্তিজীবনে একসময়ে নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকলেও, নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কখনো অস্বীকার করতে চাননি। বাংলা কবিতায় যে অসাধারণ কা- তিনি ঘটিয়েছেন, তা-ই তাঁকে আমাদের সময়ের প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভাগ্যিস, শহরের ট্রেন তিনি মিস করেছিলেন।

লেখক: দেওয়ান তাহমিদ
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চবি। 

কোন মন্তব্য নেই

enjoynz থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.