Header Ads

Header ADS

ধর্মীয় মেলায় একটি বিজ্ঞান অনুষ্ঠান । বিজ্ঞান অবিজ্ঞান অপবিজ্ঞান



বোম্বাই শহরের দাদার বাত্তালায় আষাঢ়ী একাদশীর মেলাটি বোধহয় বোম্বাই-এর প্রাচীনতম মেলা। বোম্বাই এর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকে এই মেলায় ভগবান বিঠঠল রঘুমাইকে(বিষ্ণু ও লক্ষী) দর্শন করতে এসে থাকেন। এদের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে শুধু যে বারকারিরাই( বাউলের মতো একটি সম্প্রদায়) থাকেন তা নয়, শ্রমিক, ছাত্র ও মধ্যবিত্তরাও মৃদঙ্গ ও খঞ্জনী সহযোগে নাচগানে যোগ দেন। চারিদিকে মহারাষ্ট্রের সাধু-সন্তদের নামে জয়ধ্বনি উঠতে থাকে। গত বছর, ১৯৮০ সালের মেলায় ‘লোকবিজ্ঞান সংগঠন’ আয়োজিত একটি মেলার অনুষ্ঠান মেলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘চমৎকার বাবাকা রহস্য বিজ্ঞানকা’ ( চমৎকার বাবার বিজ্ঞানরহস্য)।
একটি প্রকান্ড জটাজুটধারী প্রতিকৃতির নিচে ‘লোকবিজ্ঞান’ লেখা ব্যানারটি মেলার দর্শকদের সংগঠনের স্টলের দিকে আকর্ষণ করছিল। ঠিক মধ্যরাত্রে ভজন ও জয়ধ্বনির মধ্য দিয়ে সপারিষদ বাবার প্রথম আবির্ভাব হয়। সিল্কের গেরুয়া, তিলক আর ফুলের মালার আতিশয্যে বাবাকে এক ‘পরমপুরুষে’র মতোই দিব্যতেজসম্পন্ন দেখাচ্ছিল। ভক্তিতে অনেক দর্শকেরই মাথা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। বাবা তার নির্দিষ্ট সিংহাসনে বসে কিছুক্ষণ নিজের অবতারত্ব এবং ভাগবত কথামৃত বিতরণের পর ধ্যানে বসলেন। কিছুক্ষণ পর হঠাত বাবাজী উঠে দাঁড়িয়ে সমাধিস্থ হলেন, এবং তারপরই নিজের অলৌকিক ক্ষমতার বলে দর্শকদের অবাক করতে শুরু করলেন। শূন্য থেকে ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করে দর্শকদের মধ্যে বিতরণ করলেন; খালি কলসী থেকে পবিত্র গঙ্গোদক বের করলেন; দিব্যদৃষ্টিতে নোটের নম্বর বলতে লাগলেন; শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তির তেজ সঞ্চারিত করে রোগীকে সুস্থ করতে লাগলেন; বিনা রক্তপাতে নিজের জিভে সুচ ফুটিয়ে দিতে লাগলেন; আগুন পান করলেন; ঠোঁটে ছুঁয়ে টিউব লাইট জ্বালালেন; মানুষ এমনকি মুরগীকেও সম্মোহিত করে নানা ক্রিয়া দেখালেন;......এরকম অগুন্তি ক্রিয়াকলাপ দেখে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তারপরেই শুরু হলো এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে নাটকীয় অংশ।
হঠাত বাবা তার জটা খুলে ফেলে, মেকআপ মুছে ফেলে এবং গেরুয়া বসন ত্যাগ করে দর্শকদের হতবাক করে দিলেন। তাঁবুর মধ্যে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে এল। নকল বাবা এবার মাইক্রোফোন হাতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন-‘ ভাই ও বোনেরা, আমি কোনো বাবা নই, ভগবান নই, এমনকি কোনো অবতারও নই, আমি একশ আট নামধারী কোনো শ্রীশ্রীঅমুক মহারাজাও নই। আমি “লোকবিজ্ঞান সংগঠনের” একজন সদস্যমাত্র। আমি আপনাদের সামনে যে-সব খেলা দেখালাম তা আদৌ কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, এগুলো শুধুমাত্র হাতের কৌশল বা কারচুপি আর সম্মোহনের খেলা। এই রকম অনেক ছলচাতুরী দেখিয়ে এবং গালভরা সব চমকদার কথার সাহায্যে আমাদের সমাজে অনেক “বাবা”, অনেক “গুরুদেব”, অনেক “সাধু” সরল জনতাকে ঠকিয়ে থাকে। আপনাদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে এইরকম নানাবিধ চালাকির সাহায্যে ওরা আপনাদের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসের ঝোঁক বাড়িয়ে দেয়। ধর্মের ভেকধারী এইসব তথাকথিত অবতারদের যদি সত্যিই কোনো অলৌকিক শক্তি থাকে তবে তারা কেন লাখ লাখ ক্ষুধার্ত জনগণের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেয় না? কেন তারা অলৌকিক ক্ষমতাবলে কুষ্ঠের মতো ঘৃণ্য রোগ সারিয়ে দিতে পারে না? এর কারণ, আসলে এদের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, সব এদের বুজরুকি। যে কোনো তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার পেছনেই আছে বৈজ্ঞানিক কৌশল; আপনারা সেই বিজ্ঞানকে চিনুন, জানুন। চোখ বুজে কোনো অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করবেন না, যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এগুলোর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন। সমাজের ঐসব ধর্মব্যবসায়ী ধাপ্পাবাজদের থেকে দূরে থাকুন। বিজ্ঞানের সঠিক ব্যাখ্যা করলে তা আপনাদের অগ্রগতিরই সহায়ক হবে। আপনাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার করুন।‘
তারপর সেই নকল বাবা এবং তার সংগঠনের সদস্যরা দর্শকদের দেখানো অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের পিছনের আসল কৌশলগুলি ব্যাখ্যা করলেন। আধঘন্টার এই ছোট্ট অনুষ্ঠানটি দেখে বেরুনোর পর দর্শকদের ওপর এর স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। অনেকে এগিয়ে এসে ‘লোকবিজ্ঞান সংগঠনে’র এই ধরণের প্রচেষ্ঠার প্রশংসা করলেন এবং এর সামাজিক প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করলেন। অনেকে আবার সেই ‘বাবা’ ছদ্মবেশী ভদ্রলোকের সাথে দেখা করে ম্যাজিকগুলোর সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে চাইলেন। কেউ কেউ তাদের এত দিনের গভীর বিশ্বাসগুলো একদিনে ভেঙ্গে যাওয়াতে এতই হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন যে তাদের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে জানতে চাইলে তারা সাজিয়ে-গুছিয়ে কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। আবার অনেকে বিরূপ মতও প্রকাশ করেন, বলেন এটা একটা অর্থহীন অনুষ্ঠান।
সামগ্রিকভাবে দর্শক-সাধারণের এই প্রতিক্রিয়াগুলি অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে সংগঠনের পক্ষে জনমানসে অন্ধবিশ্বাসের গভীরতা ও ব্যাপ্তি সম্বন্ধে একটা গবেষণা চালানো সম্ভব হয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে এই ধরণের প্রত্যক্ষ গবেষণা অপরিহার্য না হলে সঠিক পথে এগুনো মুশকিল।
দশ মিনিট পর পর অনুষ্ঠিত আধঘন্টার এই অনুষ্ঠানের টিকিট ছিল পঞ্চাশ পয়সা। প্রায় ষোল-শ দর্শক এটা দেখেন।

মহারাষ্ট্র লোকবিজ্ঞান সংগঠন-এর একটি প্রয়াস।
[মূল রিপোর্ট-টি হিন্দিতে লেখেন মহারাষ্ট্রের ‘লোকবিজ্ঞান সংগঠনে’র পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী। বাংলায় অনুবাদ করেন খড়গপুর ‘সায়েন্স এডুকেশন গ্রুপ’-এর দেবাশিস মিত্র ও চন্দন হালদার।]


সংগ্রহ: পলাশ সরকার
শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চবি। 

কোন মন্তব্য নেই

enjoynz থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.