Header Ads

Header ADS

অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরীদের কথা- সুমাইয়া জান্নাত


আহমদ ছফার উপন্যাস। উপন্যাসের মূলভাব প্রথম দিকে বক্তা জাহিদের একটি উদ্বৃতিতেই ভেসে উঠেছে- “আমার কোন ধন-সম্পদ নেই। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র পরিবার আমার কিছুই নেই। যে সজীব বন্ধন একজন মানুষকে নানা কিছুর সাথে সম্পর্কিত করে রাখে, আমার ভাগ্য এমন ফর্সা যে, সেসব কিছুই আমার জোটেনি। অতীত দিনের অর্জন বলতে আমার জীবনে যেসব নারী এসেছিলো, যারা আমাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, দাগা দিয়েছে, যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, সেই-- দুঃখ-সুখের স্মৃতি চক্রটুকুই শুধু আমার একমাত্র অর্জন।” আর সে অর্জনের শব্দরূপই আহমদ ছফার উপন্যাস ‘অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী’। এটিকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলা চলে। যেখানে গল্পের কথক জাহিদ হাসান মূলত আহমদ ছফা নিজে। লেখকের প্রেমজ সত্তার বিকাশ ও বিবর্তনের নির্মাণ এই উপন্যাস। চারুকলার ছাত্রী দুরদানা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক শামারোখকে নিয়ে উপন্যাসটি রচিত। তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র, যিনি উপন্যাসের বক্তা, তার জড়িয়ে পড়ার কাহিনী উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসের একজন শক্তিমান নারী চরিত্র সোহিনী। যার সম্পর্কে জাহিদের বক্তব্য- “তুমি আমার কাছে অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা, অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ, অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী”। সেই সোহিনীর কাছে জাহিদ সেসব নারীদের সম্পর্কে লিখে জানাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে যারা তার মনে প্রেমের উপলব্ধি ঘটিয়েছে। এই স্বীকারোক্তিটাই মূলত উপন্যাস। উপন্যাসে দুরদানা ও শামারোখের সাথে জাহিদের সম্পর্কের পরিণতি দেখানো হলেও শেষ পর্যন্ত সোহিনী আর জাহেদের সম্পর্কের কোন পরিণতি লেখক দেখান নি।

কিন্তু উপন্যাসটি নিছক প্রেমেরই নয়। দুরদানা, যে মূলত বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাস্কর শামীম সিকদার, সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের বোন, তার গল্প বর্ণনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের চরমপন্থি বাম সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র ফুটে ওঠে। এই দ্বন্দের জের ধরেই লেখকের বন্ধু, ৬০ দশকের বিখ্যাত কবি হুমায়ুন কবির খুন হন। এখানে উল্লেখ্য যে, (বাস্তবে এবং উপন্যাসেও) সিরাজ সিকদারের সাথে হুমায়ুন কবিরের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। তাই দুরদানার সাথে জাহিদ হাসানের সম্পর্ককে অন্য অনেকের মতো হুমায়ুনও মেনে নিতে পারেন নি। জাহিদকে তিনি পিস্তল দেখিয়ে হুমকিও দিয়েছিলেন। উপন্যাসে কোনো বাস্তব চরিত্রের মূল নাম ব্যবহার করা না হলেও হুমায়ুন কবিরের মূল নামই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। গুণ্ডামার্কা দুরদানার অনারীবাচক বৈশিষ্ট্যই লেখককে তার প্রেমে আকৃষ্ট করেছে। উপন্যাসের একটি উক্তি, “নারী আসলে যা, তার বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় তখন তার আকর্ষণ করার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায়।” কিন্তু এক সময় দুরদানার নারীবাচক বৈশিষ্ট্যও লেখকের চোখে ধরা পড়ে, সেজন্যই হয়তো সেই প্রেমে চির ধরতে থাকে। এরপর নতুন গল্পের মতো শুরু হয় “কন্যা শামারোখ”-এর কাহিনী। যাকে লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর শামারোখের কাছে আস্তে আস্তে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে থাকে জাহিদ হাসান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার হীনতা ও স্বার্থের রাজনীতির দেখা মেলে এখানে। উপন্যাসের উক্তি “বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্বর এবং স্যাডিস্ট মানুষেরা রাজত্ব করে।” উক্তিটির যথার্থতা উপন্যাসে দেখা যায়। এখানে জাহিদ সোহিনীকে অর্ধেক নারী, অর্ধেক নারী ঈশ্বরী রূপে আখ্যায়িত করলেও তার এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে লেখক জাহিদের জীবনে আসা নারীদেরকে অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী হিসেবে ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর সেই নারীদের কথা বলতে গিয়ে আহমদ ছফা শুধু নিজের জীবনকে নয়, সমকালীন সমাজের জীবনীকেই তুলে এনেছেন। তাই এটি ঠিক আত্মজীবনীমূলক নয়, সমাত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।

লেখক; সুমাইয়া জান্নাত
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চবি

কোন মন্তব্য নেই

enjoynz থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.