জাক লাকাঁর ভাষাচিন্তা – নূরে এলাহী শাফাত | দর্শন
বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ চষে বেড়ানোর নানা ক্ষেত্রে, বর্গ, পরিসীমা আছে। এসব ভাণ্ডারকে কেউ আলোড়িত করেছেন দর্শন দ্বারা, কোনো কোনো চিন্তক তাতে যোগ করেছেন ইতিহাস, নৃতত্ত্ব কিংবা ধর্মতত্ত্বকে। ফরাসি ভাবুক জাক লাকাঁ হচ্ছেন সেই মনীষা যিনি তার চিন্তার জমিনকে ভাষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কাঠামোগত ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত লাকাঁর আধুনিক সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ-আগ্রহ ছিল। লাকাঁর ভাষাদর্শন চিন্তার একটা জটিল খোলস বেশ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। তথাপি ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাক লাকাঁর গদ্যের দুরূহতা সত্ত্বেও তার চিন্তায় এমন কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে যার সাথে দর্শনের সরাসরি সম্পর্ক আছে, যা কিনা উত্তরাধুনিক সাহিত্যের সাথে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত।
লাকাঁ পাঠের আগে আমাদের বুঝতে হবে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণের অনুপুঙ্খ ধারনা, কারণ লাকাঁনীয় ভাষাচিন্তার মর্মশাঁসে যার ভাবনা জড়িয়ে আছে, তিনি ইয়োরোপের বিখ্যাত মনোদার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। যেমন মার্ক্স বোঝার আগে আমাদের ফয়েরবাখ বুঝতে হয়, আবার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বোঝার জন্য আমাদের তাকাতে হয় হেগেলীয় দ্বান্দ্বিক ভাববাদের দিকে।
লাকাঁ মানুষী চেতনার বস্তুগত সমস্যাগুলোকে সবসময় মোকাবেলা করেছেন, যেগুলো প্রায় সর্বাংশেই দার্শনিক ব্যাবস্থার সাথে সম্পর্কিত। তাঁর মূল প্রসঙ্গই যেহেতু মানুষের ভাষা, সে জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি আবিষ্কার করেন তামাম প্রাণীকুল থেকে মানুষের আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ার কারণ- মানুষের ভাষা আছে এবং তা দিয়ে সে কথা বলতে পারে। এজন্যই দার্শনিক লাকাঁ তার উদ্ভাবিত মন, মনস্তত্ত্ব ও মনোসমীক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানুষী ভাষার উপর, কারণ ভাষা ছাড়া চিন্তাজগত ও তার প্রকাশ অসম্ভব। ভাষা ব্যতিরেকে মানুষের অভিজ্ঞাতলাভ ‘অভিজ্ঞতা’ হয়ে ওঠে না। একজন বোবা মানুষ ভাষা বোঝে, সেই বোঝার ক্ষেত্রে তার নির্দিষ্ট বোঝাপড়াও আছে। কিন্তু সমাজে যখনই সে তার বোঝার অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে অসমর্থ, তখনই শোনার ভেতর দিয়ে বোবা ব্যক্তিটির ভাষিক অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞতা-সংশ্লিষ্ট হয়ে ওঠে না। এজন্য জাক লাকাঁ চিন্তা, ভাষা ও অভিজ্ঞতাকে কখনো এক করে দেখেননি।
শিশু খুব দুষ্টুমি করছে। তার মা তাকে বকা দিয়ে বলছে, ‘তোর বাবা আসলে মজা দেখবি’। মায়ের একথা শুনেই শিশুটি শান্ত হয়ে গেল। প্রশ্ন আসে, "মজা দেখবি" শাব্দিক ও বাক্যার্থে ইতিবাচক হলেও তার মধ্যে যে ভয়াবহতার ইঙ্গিত আছে শিশুটি তা বুঝল কীভাবে? এখানে, মায়ের চেহারা, অভিব্যক্তিই শিশুটিকে ভীত করে। ফলে মায়ের "মজা দেখবি"কে সে আগত হুশিয়ারবার্তা হিসেবে গ্রহণ করেছে, যার সাথে শিশুর ভাষা বোঝার অভিজ্ঞতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মানুষ ছাড়া অন্যান্য সব প্রাণী প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত, তাড়িত। তাই সেসব প্রাণীর পক্ষে কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা স্মৃতি আঁকড়ে ধরা সম্ভব হয় না।
লাকাঁ বলেছেন, ভাষাবিনা নামকরণ সম্ভব হয় না। সম্বন্ধ এবং আত্মীয়তার যে ধারনা তা ভাষাগতভাবেই নির্মিতি লাভ করে এবং অর্থবোধক হয়। কাকা, খালা, মামাতো বোন, স্ত্রী, ভাতিজা ইত্যাকার নাম ভাষার ভেতর দিয়েই ফলপ্রসূ হয়। ফলে এসব সম্পর্কই আমাদের নামকরণের মধ্য দিয়ে বলে দেয় কাকে সম্মান করতে হবে, আর কাকে স্নেহ করব, কার সাথে যৌনসংগম করব অন্যদিকে কার সাথে যৌনাভূতিও প্রকাশ করা যাবে না। আমরা যখন গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়ি তখন সেখানে ভাষা ব্যবহারের প্রয়োগের ব্যবস্থাপনা সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রকে ঔজ্জ্বল্য প্রদান করে, কিন্তু কীভাবে? যখন "সর্বহারার শ্রেণীসংগ্রাম" বলা হয় তখন কমিউনিজমের কথাই আমাদের মাথায় আসে, পক্ষান্তরে "মজলুমের জেহাদ"বললে আমরা ইসলামী মতাদর্শের অস্তিত্ব পাই। কাজেই ধর্ম, জাতি, সংবিধান, বাহিনী, মতবাদ ও রাষ্ট্রের নানান অবস্থান ও তার দৃষ্টিকে ভাষার মাধ্যমেই আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি। এবং সে সংজ্ঞার ভেতর দিয়ে আমরা জগৎ-জীবন ও সাহিত্যের সমাজকে। যখন আমরা "নারী" উচ্চারণ করি, তখন নারীর শরীরী অস্তিত্ব সবার সামনে উদ্ভাসিত হয়, তার প্রধান কারণ নারীর লিঙ্গীয় ধারনা: যে কথা বলবে কোমলভাবে, রান্না সুস্বাদু হবে, ঘর সংসার করবে। অন্যদিকে যখন উচ্চারণ করি "পুরুষ", তখন তার লিঙ্গীয় পরিচয়ের পাশাপাশি ভাবি তার শরীর কোমল নয়, চেহারা তেমন সুন্দর নয়, মাঠে কিংবা কর্মক্ষেত্রে তার অবস্থান থাকে। উপরের কথাগুলো নির্দিষ্ট সমাজের অবস্থানের কারণে বলা, যাকে আমরা ভাষার উসিলায় হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হই।
লাকাঁর মতে ভাষার লিঙ্গ, ভূগোল, সমাজ, রাজনীতি, মন আছে। আছে ভাষার বহুমাত্রিক জবান। কাজেই ভাষা একবাচনিক (singular) নয় বরং বহুরঙের, বহুবচনের। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কোনো হোটেলবয়কে পুরী আনতে বললে সে আটা দিয়ে বানানো, ফোলানো খাবার নিয়ে আসবে। পক্ষান্তরে সিলেটের কোনো জনরাস্তায় বন্ধুকে "পুরী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে" বললে আশপাশের মানুষ ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাবে। কারণ সিলেটে পুরী মানে মেয়ে। মোটাদাগে এটাকেই বলা যায় ভাষার স্থানিক রূপ। এটাই লাকাঁর ভৌগলিক ভাষা।
জড়বাদী লাকাঁ ভাষার মিস্টিসিজমকে অস্বীকার করেছিলেন এবং ভাষার রুহানিয়াত (ভাব) বিরোধী সাহিত্য আন্দোলনকে ফরাসি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সাহিত্যে, ভাষায় লাকাঁর এই ভাববিরোধী সংগ্রাম বুঝতে হলে আরেক ফরাসি চিন্তক জাক দেরিদার অধিবিদ্যাবিরোধী ভাষিক আন্দোলনকেও বোঝা দরকার। লাকাঁ দেখান, রেনেসাঁর শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপীয় সমাজে যতগুলো দর্শন ও ভাষা সাহিত্য তৈরী হয়েছে তার অন্তর্মূলে ভাববাদী চেতনা প্রখর ছিল, যা মানুষের অস্তিত্ববাদী ধারনাকে ভাবভাষার বেড়াজালে ধূসর করে তোলে। তাই গ্রিক পুরাণের নামে, প্রকৃতিবাদের নামে, ইউরোপীয় মানবতাবাদী সমাজে যেসব জ্ঞানভাণ্ডার, দর্শন ও ভাষা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে ভাবের (অ-বস্তুবাদ) উপস্থিতির কারণে জড়বাদী লাকাঁ এয়াব সৃষ্টির বিরুদ্ধে ভাষিক বিপ্লবের ডাক দেন। এই ভাষাগত চিন্তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে সমস্ত ধর্মীয়, মানবতাবাদী ভাষাকে লাকাঁ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। সেই দিক থেকে জাক লাকাঁর ভাষাচিন্তাকে নিরীশ্বরবাদের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়।
ভাষা আর সাহিত্য যেহেতু পরস্পর অবিচ্ছেদ্য, তাই সাহিত্যের গভীর বোধ ও তার চাষাবাদের জন্য সাহিত্যশীল মানসকে জাক লাকাঁর ভাষাদর্শনের দিকে তাকাতেই হয়। বিশেষ করে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সাহিত্যের বাঁক এবং বৈপরীত্যের দার্শনিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে চিন্তা করতে হলে লাকানীয় দর্শনের পাঠ নিতে হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লাকাঁর ভাষাচিন্তা দর্শন ও সাহিত্যবোধের বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোতকে একই সুতোয় গেঁথেছে। এমন না যে লাকাঁর ভাষাদর্শনের বোধের উপর সাহিত্য ও সাহিত্যমনকে নির্ভর করতে হয়। কিন্তু নিঃসন্দেহে লাকাঁর ভাষাচিন্তা সাহিত্যের জমিনকে অনেক বেশি পরিগঠিত করে তোলে।
লেখক: শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই