Header Ads

Header ADS

চিৎকার - ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ । গল্প

ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ


মি জানি। এতক্ষণে ওরা সব জেনে গেছে। এসব বিষয় চাপা থাকে না। আজ রাতটা পোহালেই কাল সকালে দরজায় পুলিশ এসে হাজির হবে। আমাকে শক্ত হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে হাজতে পুরে দেবে। পুলিশের গাড়িতে হয়তো দীপেনদা'রাও থাকবে। তাদের হাতেও ঝুলবে হাতকড়া।

গতকাল আরেকজনকে যখন কেবল কথা বলার অপরাধে মেরে ফেলা হলো, আমরা আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি।মিছিল-সমাবেশ বন্ধ। স্লোগান বন্ধ। কেউ একটু আওয়াজ তুললেই লাঠির বাড়ি আর হাজতবাস অথবা মৃত্যু। কোনো প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই। কার ঠেকা পড়েছে আগ বাড়িয়ে মরতে যাওয়ার! আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। রঙ আর তুলি নিয়ে বেরিয়ে গেছি রাতে।

শালা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বাকস্বাধীনতা। আমার মুখের কথা ওরা কেড়ে নিচ্ছে, দিনে দুপুরে লাশ হয়ে ফিরছে যুবক, ছোট্ট মেয়েটা ধর্ষিত হয়ে গেলো। অথচ কোনো বিচার নেই। এরকম অবস্থায় কীটপতঙ্গের মত চুপচাপ বাসায় বসে বাংলা, অংক গিলবো?

আমি জানতাম, আমাদের দেয়ালে লেখা কথাগুলো হয়তো খুব ছোট, রঙ লেপ্টে গেছে অনেকখানি, তবুও কথাগুলো স্পষ্ট পড়া যায়- “যেই সমাজ পচা গলা, সেই সমাজ ভেঙে দাও।”,
“একটা কলম রুদ্ধ হলে, হাজার কলম চলবে।”, “যেই হাত মানুষ মারে, সেই হাত ভেঙে দাও।” আরো অনেক অনেক লেখা, অনেকগুলো দেয়ালে। শহরের আনাচে কানাচে। অলিতে গলিতে।

আমি ঠিক জানতাম এই ছোট কাজটাও ওদেরকে ভয় ধরিয়ে দেবে। ওরা অস্থির হয়ে উঠবে, তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করবে সেই বখে যাওয়াদের, যারা রাতের আঁধারে এসব লিখে গেছে।
কেননা তারা প্রশ্নকে ভয় পায়, একটা ছোট আওয়াজকে ভয় পায়, দাবিকে ভয় পায়, স্লোগানকে ভয় পায়,মিছিলকে ভয় পায়, মুষ্টিবদ্ধ হাতকে ভয় পায়।

দীপেনদা হয়তো আমার কথাগুলো শুনলে বেশ মজা পেত।হয়তো ভাবতো, ফ্যান্টাসিতে টগবগ করছি। এখনো ভেতরের জায়গাটা অতটা শক্ত হয়নি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমরা কিছু হলেও করেছি। অন্তত চুপ করে থাকিনি।

আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। এর আগে কখনো এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। কী কতটুক কিভাবে নেওয়া উচিত, কতটুকু নেয়া যাবে, সেসব বিষয়ে বুঝে উঠতে পারছি না। কিছুটা কনফিউজড। ভেবেছিলাম দীপেন দা'কে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু কল দেয়া হলো না। মা এখনো কিছু জানে না। কিছু বলিনি। মা হয়তো ভেবেছে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে, যাক। বাবা ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা। মাকে পাশ কাটিয়ে আমার রুমে এসেছে। বাবা আমাকে কিছু বলছে না।কোনো বকাঝকা করছে না। চুপচাপ এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে।

বাবা আমাকে কখনো মাথা নত করতে শেখাননি। বাবা আমাকে শিখিয়েছেন যা যাহচ্ছে সব একটা প্রক্রিয়ার ফল। এই যে আমাদের বাসায় প্রতিদিন ডাল আর শাক, আর অন্য বাসায় প্রতিদিন দলা দলা মাংস ওটাও একটা প্রক্রিয়ার ফল।এই যে আমি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই, আমার বন্ধুটা ফেল করে হতাশ হয়, কান্না করে, এটাও একটা প্রক্রিয়ার ফল। বাবা বলতেন -“এই যে সেদিন আমি তোকে একটা চকলেটের লোভ দেখিয়ে সারাদিন ধরে তোকে দিয়ে আমার বইয়ের তাক, মোটামোটা বইগুলো পরিষ্কার করিয়ে নিলাম, তুইও চকলেটের লোভে সারাদিন খেটে সেগুলো পরিষ্কার করে ফেললি। কিন্তু দিনশেষে আমি আর তোকে চকোলেটটা দিলাম না। তুই দুঃখ পেলি কিন্তু আমি বাবা বলে তুই আমাকে কিছু বলতে পারলি না, এটাই হচ্ছে পুঁজিবাদ।” আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করি- তাহলে কি তুমি পুঁজিবাদী? বাবা হাসেন।

বাবা আজও হাসছে। আমার ব্যাগ গোছানোটা সম্ভবত বাবার খুব হাস্যকর লাগছে। তিনি হাসতে হাসতে বললেন ব্যাগটা রেখে দিতে। ওরা বাইরে থেকে কোনো ব্যাগ নিতে দেয় না। আমি ব্যাগটা রেখে দিলাম। আমাকে সম্ভবত আজ একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে। বাবা আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। আমি ঘুমোতে গেলাম।

আমার কি একটু ভয় করছে?

আমার দীপেনদা কে দেখলে ভয় কেটে যায়। বারবার দীপেনদা’র কণ্ঠস্বর বুকের ভেতর বাজছে- “আমরা যেন আমাদের জীবনের কাছে হেরে না যাই। আমরা যেন সময়ের কাছে অপরাধী না হই। মনে রাখতে হবে-যেই ব্যাবস্থায় আমরা আছি,সেটাকে আমরা বদলাতে চাই। আমরা স্বপ্ন দেখছি সুন্দর, সাম্যের একটি পৃথিবীর। প্রত্যেকটি মানুষের জন্য নিরাপদ একটি পৃথিবীর। সেই পৃথিবী এমনি এমনি আসবে না।তার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। বিদ্রোহ করতে হয়। যদি আমি নিরবে বসে থাকি, তাহলে আমিও কোনো না কোনোভাবে এসব অপব্যাবস্থাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।” দীপনদা বলতেন, “মনে রাখবেন-একা একা ভালো থাকা যায় না। কেননা আমার জীবন আমার একার উপর নির্ভরশীল নয়। ঐ গ্রামের কৃষক ধান না ফলালে আমরা না খেতে পেয়ে মারা যাব, ওই শ্রমিক কাপড় তৈরি করা বন্ধ করে দিলে আমরা কাপড় পরতে পারবো না। তাই ওই কৃষক যখন তার ধানের ন্যায্য মজুরী পায় না, তখন তার জন্যও আমাদের লড়তে হবে।”

একটা কলম আর খাতা নিয়ে যাব ভাবছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, দীপেনদা আছেন। উনি তো নেবেনই এসব। দীপেনদা জেলে বসেও কিছু না কিছু করবেন।

সকালবেলা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরের দরজায় কোনো পুলিশ এসে দাঁড়ায়নি। বাইরে কোনো পুলিশের গাড়ি নেই। কিন্তু ১০টা নাগাদ থানা থেকে ফোন আসে। তারা আমাকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। সময় আধাঘণ্টা। এর মধ্যেই থানায় উপস্থিত হতে হবে।

আমার ২৫ মিনিট লেগেছে।

আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ রুমে নেয়া হলো।

ওই রুমে দীপেনদারাও বসে আছে। এতক্ষণ একটু ভয় ভয় করছিলো। এখন দীপেনদাকে দেখে ভয় চলে গেছে। দাদাকে দেখলেই ভয় কেটে যায়।

আমরা দীপেনদাসহ ৫ জন একসাথে বসে আছি একটা টেবিলে। অন্য দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো ২০-২৫ জন।সবাইকে বিভিন্ন কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। এরা সবাই হবু অপরাধী। আমরাও।

আমাদের সামনে কয়েকজন পুলিশের লোক। চোখে মুখে খুব বিরক্তি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ফাঁসির আসামী বসে আছে তাদের সামনে। দেখেই মনে হয় খুব অপদস্থ করার পরিকল্পনা নিয়ে বসেছে তারা। একটা কাগজে আমাদের সবার নাম লিখতে দেয়। আমরা নাম লিখে কাগজটা ফেরত দিই।

আশেপাশে কথা বলার আওয়াজ হয়। পুলিশ অফিসার জোরে ধমক দিয়ে ওঠেন। সব চুপচাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ দীপেন দাকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করেন—
“What you all have done last night?”

ইংরেজীতে মাস্টার্স দীপেনদা, বাংলায় উত্তর দেন- “যা আপনি বলতে পারেননি এতদিন, তা'ই আমরা ওই দেয়ালে লিখে বলেছি। আপনি কি চান না আপনার মেয়ের সমান কেউ ধর্ষিত হলে তার প্রতিবাদ হোক? অথবা আপনি কি শিওর যে কাল আপনার ভাই রাষ্ট্রের কোনো অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে খুন হয়ে গেলে আপনি তার বিচার পাবেন অথবা তা নিয়ে অন্তত কোনো কথাও আপনি বলতে পারবেন?”

দীপেনদা’র এমন প্রশ্নের সামনে পুলিশ অফিসার থতমত খেয়ে যায়। থতমত খেয়ে মাটির দিকে তাকায়। চোখ উপরে ওঠাতে পারে না। কিছুক্ষণ পর চোখ মাটিতে রেখেই নিচু গলায় প্রশ্ন করে। ঠিকঠাক পুরোটা বোঝা যায় না।
-তাহলে আপনারাই ঐ কাজগুলো করেছেন?
দীপেনদা আমার দিকে তাকায়। আমিও তাকাই দীপেনদা'র দিকে। আমি তাকাতেই দীপেনদা হো হো করে হেসে ওঠে।দীপেনদা'র বিকট শব্দে হাসার অভ্যাস। এখনো সেভাবে হাসছেন। আমিও হাসছি। এখন আশেপাশের সবাইও হাসছে।হো হো করে হাসছে। হাসির শব্দ বাড়ছে।

হো হো হো হো হো হো...

মাঝখানে পুলিশ অফিসার চেয়ারে বসে আছে। কোনো প্রতিবাদ করছে না। চুপ করে বসে আছে। কলম নাড়াচ্ছে।খাতায় কিছু লিখতে পারছে না। একটা টিকটিকি টেবিলের ওপর হয়ে সোজা পুলিশ অফিসারের ঘাড়ের উপরে গিয়ে পড়েছে। অফিসার সেটাকে ফেলছে না। ঘাড় নাড়াচ্ছে না।

সবাই হো হো করে হাসছে।

লেখক; ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ
শিক্ষার্থী, নাট্টকলা ইন্সটিটিউট, চবি।

কোন মন্তব্য নেই

enjoynz থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.