বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৯

দ্যা গুড লায়ন - আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। অনুবাদ: আবিদ খন্দকার ‍



কোনও এক দেশে থাকতো এক সিংহ। সেদেশের অন্য সব সিংহ ছিলো খারাপ। তারা প্রতিদিন হরিণ, জেব্রা আর একেক রকমের এন্টিলোপ ধরে খেয়ে ফেলতো, সুযোগ পেলে একেকদিন মানুষও খেয়ে ফেলতো। সোয়াহিলি, উম্বুলু আর ওয়ান্ডারোবস্‌দের খেতো, তবে সবথেকে বেশি ভালোবাসতো বাঙালি বণিকদের খেতে। কারণ তারা একটু মোটাসোটা হতো, স্বাদও হতো দারুণ।

তবে এই সিংহটিকে আমরা ভালোবাসি। কারণ সে খুবই ভালো আর তার পিঠে ডানা আছে। এই ডানা নিয়ে অন্য সিংহেরা মশকরা করতো। একেক সময় টিপ্পনী কেটে একজন আরেকজনকে বলতো, “দেখ দেখ! ডানাওয়ালা সিংহ যায়!” এই শুনে অন্য সিংহেরা তাদের গর্জনের স্বরে হো হো করে হাসতো। তার খাবার দেখেও অন্য সিংহেরা হাসাহাসি করতো। কেননা সে এতোই ভালো ছিলো যে, কেবল পাস্তা আর চিংড়ি খেতো।

খারাপ সিংহেরা গর্জন করে হাসতো আর হিন্দু বণিকদের খেতো, পাশে তাদের স্ত্রীরা বিড়ালের মতো করে চুক্‌ চুক্‌ করে খেতো রক্ত। তাদের এই উৎসবে ছেদ পরতো শুধুমাত্র হাসবার জন্য আর ভালো সিংহের ডানার দিকে দাঁত খিঁচিয়ে তাকানোর জন্য। সত্যিই ওরা খুব দুষ্ট ছিলো।

ভালো সিংহ শুধু জানতে চাইতো ওদের কাছে ইতালিয় পানীয় বা আমেরিকানো কফি আছে কিনা, সে তো আর বাঙালি বণিকের রক্ত খায় না! এমনই একদিন দুষ্ট সিংহেরা মিলে সদ্য শিকার করা মাসাইদের গরু খাচ্ছিলো, ভালো সিংহ তাদের পাশে বসে খাচ্ছিলো স্যুপ আর এক গ্লাস পামোদরো। এই দেখে খারাপ সিংহের দল গেলো ক্ষেপে। দলের মধ্যে সবথেকে দুষ্ট সিংহী ক্ষেপে গিয়ে বললো, “নিজেকে কী মনে করো তুমি? আমাদের থেকে খুব ভালো?” তার গোঁফে তখনও লেগে ছিলো হিন্দু বণিকের রক্ত। রাগে গড়গড় করতে করতে আবার বললো, “কোত্থেকে এসেছে ও?” এই শুনে দলের সব সিংহ একসাথে গর্জন শুরু করে দিলো।

ভালো সিংহ বললো, “তোমরা জানো, আমার বাবা কতো মহান। তিনি এমন এক দেশে থাকেন, যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন বিরাট মিনারের নিচে। সেখান থেকে দেখা যায় হাজার হাজার পায়রা। তাদের সবাই আমার বাবার প্রজা। তারা ওড়ে বহমান নদীর মতো। আমার বাবার সামনে চারটি ঘোড়া ব্রোঞ্জের এক পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে, কারণ তারা বাবাকে ভয় করে। আমার বাবার শহরে মানুষ হেঁটে নয়তো নৌকায় চড়ে চলাচল করে, সত্যিকারের ঘোড়া তাঁর সামনে হাঁটতে ভয় করে, তাই।”

দুষ্টু সিংহী গোঁফে জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলে –
“তোমার বাবা হলো একটা শকুন!”
দুষ্ট সিংহের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠে –
“তুমি মিথ্যাবাদী।”
দুষ্টু সিংহী আবার বলে,
“তুমি একটা অপদার্থ, শকুনের বাচ্চা। ডানাসুদ্ধ তোমাকে খেয়ে ফেললেই ভালো হবে।”

এই শুনে ভালো সিংহটি ভয় পেয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো দুষ্টু সিংহীর লেজ শিকারের ভঙ্গিতে উঠানামা শুরু করে দিয়েছে। তার গোঁফে জমে থাকা রক্ত আর নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ লাগছিলো নাকে, কেননা দুষ্টু সিংহেরা কখনো দাঁত পরিষ্কার করতো না। সে আরও দেখছিলো দুষ্টু সিংহের থাবার নিচে লেগে আছে বাঙালি বণিকের এক টুকরো মাংস। এসব দেখে ভালো সিংহ ভয়ে ভয়ে বললো, “আমাকে মেরো না। আমার বাবা একজন সজ্জন ব্যক্তি। সবার কাছে তিনি সম্মানীয়।”
দুষ্টু সিংহী সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভালো সিংহের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে ভালো সিংহ তার ডানায় ভর করে উপরে উঠে গিয়ে রক্ষা পেলো। দুষ্টু সিংহের দল তার নাগাল না পেয়ে রাগে গড়গড় করছিলো। ভালো সিংহ উপর থেকে মনে মনে বলছিলো, “সব ইতরের দল!”

পুরো দলের উপরে একবার চক্কর কেটে সে তাদের আরও রাগিয়ে তুললো। তারপর দুষ্টু সিংহীর চোখে দেখার জন্য কিছুটা নিচে নেমে এলো, সাথে সাথে সেই সিংহী লাফ দিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ভালো সিংহ তার জ্ঞানের ছাপ রাখতে স্প্যানিশে তাদের বিদায় জানাতে বললো, “Adios”। সে আবার খুব সংস্কৃতিবান সিংহ ছিলো তাই, ঝকঝকে ফরাসী ভাষায় আবার বললো, “Au Revoir”। এই শুনে দলের সব সিংহ তাদের বর্বর ভাষায় গালাগাল করতে শুরু করে দিলো।
এরপর ভালো সিংহটি চক্রাকারে একটু ঘুরে উড়তে শুরু করলো তার স্বপ্নের শহরের দিকে। তার বাবার সেই চৌরাস্তায় এসে অবতরণ করলো সে। সবাই তাকে দেখে খুশী হলো। সেখান থেকে অল্প একটু উড়ে গিয়ে বাবাকে চুমু খেলো সে। দেখলো, ঘোড়াগুলি এখনও এক পা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা দেখতে সাবানজলে ফোলানো বুদবুদের চাইতেও সুন্দর। গির্জার ঘণ্টাঘরটিও আছে ঠিক আগের মতোই। সন্ধ্যা নামায় পায়রাগুলি উড়ে যাচ্ছিলো নিজ ঘরের দিকে।

বাবা জানতে চাইলো, “দেশের সবাই কেমন আছে?” “ওরা সব ইতরই আছে এখনো।” উত্তর দেয় ভালো সিংহ। বাবা বললো, “দেখো, আমাদের এখানে রাতের জন্য বাতি লাগানো হয়েছে।”
দায়িত্বশীল সন্তানের মতো জবাব দিলো সে, “দেখেছি।” ছেলের উপর নির্ভর করে বাবা বললো, “ এই আলো অবশ্য আমার চোখে লাগে।” তারপর আবার বললো, “ তাহলে, এখন কোথায় যাবে?” ভালো সিংহ জবাব দিলো, “হ্যারির পানশালায়।” বাবা বললো, “তাহলে সিপ্রিয়ানীকে বোলো, ওর পাওনা মিটিয়ে দিতে আমি যাবো শীঘ্রই।” “হ্যাঁ বাবা বলবো।” উত্তর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো সে।

পায়ে হেঁটে হ্যারির পানশালায় পৌঁছাল সে। সিপ্রিয়ানীর এখানটাতেও তেমন কিছুই বদলায়নি। তার আবার মনে হচ্ছিলো, হয়তো শৈশব থেকে সে নিজেই বদলে গেছে। সিপ্রিয়ানী তাকে দেখেই চিনে ফেলেছিলো। অভিবাদন জানিয়ে সিপ্রিয়ানী বললো, “কী খাবে? এক গ্লাস, হিন্দু বণিকের রক্ত দেবো কি?” ভালো সিংহ চমকে উঠে বললো, “না না! এক গ্লাস কফি হবে কি?” সিপ্রিয়ানী উত্তর করলো, “হতে একটু সময় লাগবে। ততক্ষণে বাঙালি বণিকের মাংসের একটা স্যান্ডউইচ খেতে পারো।”

ভালো সিংহ অবাক হয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো।


অনুবাদক:

আবিদ খন্দকার
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, মাস্টার্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন