Header Ads

Header ADS

মা-বিষয়ক পাঁচটি কবিতা



কখনো আমার মাকে

শামসুর রাহমান


কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।
যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !

আমাদের মা

হুমায়ুন আজাদ

আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের মা আজো টলমল করে।

কিছু মনে নেই

আল মাহমুদ

কাল আমি আমার মার সাথে অনেক্ষণ কথা বলেছি।
অদ্ভুত বৃদ্ধা। একদা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন।
সম্ভবত এখন বিশ্বাস হতে চায় না। যখন মিটমিট করে
আমাকে দেখলেন। আমার গরম লাগছিল।
আমি বললাম, চলো মা আমরা একটু চা খাই।
বুড়ি হেসে তসবীহ টিপতে লাগলেন,
তোর যেখানে জন্ম হয়েছিল মনে আছে?
নিম গাছের নিচে ছনের চালায়। সে রাতে
আমাদের এক ফোটা চা-ও ছিল না।
আমি কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললাম,
না মা, কিছু মনে নেই।

পেঁচার ডাকে আমার ভয়, এদিকে তোর কান্না
ঘরে নেই পুরুষ। তোর বাপ গেছে চরের ধান
পাহারা দিতে। কে-যেনো আজান হাঁকলো
হাজী শরীয়তের মতো গলা। ধাই মেয়ে
তোকে দোলাতে দোলাতে বললো,-
বল লেংটা তুই কোন মসজিদে যাবি?-
মনে আছে?

না মা, আমাদের কাপ জুড়িয়ে
পানি হয়ে গেল যে!'


মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া

আপন মাহমুদ

মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে
শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো
পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি

মা, পৃথিবীর যেকোনো নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা
যায় না— তাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত-বিভ্রান্ত সেই প্রজাপতিটার
ডানা থেকে যখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিল রঙের আকুতি— রঙের সেই অপচয় ঘোচাতেই সম্ভবত জন্ম হয়েছিলো পৃথিবীর আর সব প্রজাপতির

মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে! অথচ, তার মুুখের দিকে
তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নি— জীবনে একটাও প্রজাপতি তার
খোঁপায় বসেছে।

স্বপ্ন

ইমতিয়াজ মাহমুদ

মা এত কম উপকরণ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন
যে অবাক হতে হয়
তিনি দেখেন
সবুজ মাঠ
আর
সবুজ ঘাস
ঘাসের মধ্যে দৌড়ে বেড়ায় এগারটা হাঁস
এরপর
দেখা
যায়
একটা করাতকল
যেটা পার হতে গিয়ে হাঁসগুলোর
গলা কাটা পড়ে
মা হাঁসগুলোর নাম ধরে
ডাকা শুরু
করেন
মা আমার নাম ধরে ডাকতে থাকেন
আমি তার কণ্ঠের পেছনে
দৌড়াতে দৌড়াতে
স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ি
এত কম উপকরণ নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন
তিনি দেখেন
সবুজ মাঠ
আমি সেই মাঠের মধ্যে চলে এসেছি
সবুজ ঘাস
আমি ঘাসের নিচে আটকা পড়েছি
মা আমার নাম ধরে ডাকেন
আমি বের হতে পারি না
আমি আর বের হতে পারি না
বুকের
মধ্যে
দৌড়ে
বেড়ায়
গলাকাটা হাঁস!

সম্পাদনা: হুইসেল

কোন মন্তব্য নেই

enjoynz থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.